আজ || শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
শিরোনাম :
  সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার দুর্নীতিবাজ সাইফুলকে জেলা প্রশাসক পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবি       টানা তিন জয়ে শ্রীলঙ্কাকে সিরিজ হারাল বাংলাদেশ       মৃত দাদির জন্য খাটিয়া বহনকালে ট্রাকের ধাক্কা, নাতিসহ নিহত ৩       বিএসএফের গুলিতে নিহত জয়ন্তর মরদেহ ফেরত       গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ ফেরত দিলো বিএসএফ       পরিকল্পনা বদলে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে ৬টি প্লট দেয় রাজউক       পেট্রোবাংলায় তিতাসের কর্মীদের হামলা-ভাঙচুর       সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত       ফকিরহাটে পিকআপ-ইজিবাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৪       ঠাকুরগাঁওয়ে বিএসএফের গুলিতে জয়ন্ত কুমার নামে বাংলাদেশির মৃত্যু    
 


বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আবু বকর স্মরণে

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আবু বকর

  মীর জিল্লুর রহমান
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আঞ্চলিক সংগঠক মোড়ল আবু বকর জীবোদ্দশায় অসম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক, সমাজ পরিবর্তনের ও দূর্নীতিমুক্ত আধুনিক বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বিপ্লবী আদর্শের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তার আদর্শ জীবন আচরণে। সকলকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করবে একাত্তরের অকুতোভয় এই বীর সেনানী। মোড়ল আবু বকর জন্মগ্রহণ ২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৪৯ সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত তালা উপজেলাধীন কানাইদিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম-আলী বক্স মোড়ল, মাতার নাম-আছিয়া, তিনি পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান। তিনি স্থানীয় কানাইদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পাশ^বর্তী কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে সাতক্ষীরা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য রাজশাহী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ভূগোল বিষয়ের উপর সম্মান ও এমএ পাস করেন। ছাত্র জীবনেই ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শত্রু সেনাদের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে পাইকগাছা থানার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা স.ম বাবর আলী নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার একটি দল প্রথমে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। মোড়ল আবু বকর ঐ দলের নেতৃত্ব দেয়াকালীন ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে ঐ দল থেকে ২১ জন মুক্তিযোদ্ধা বিভাজন হয়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শামসুল আরেফিন এর নেতৃত্বে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ অঞ্চল উক্শা সীমান্তের নদী পার হয়ে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া বড়দল হয়ে তালা উপজেলার জালালপুর গ্রামের প্রায়ত: আওয়ামীলীগ নেতা মোড়ল আব্দুল করিম (বি,এ) এর বাড়ীতে আসেন এবং ঐ রাতেই তালা সদরসহ কপোতাক্ষ নদের পূর্ব প্রান্তে পাকিস্তানী কমিউনিষ্ট বাহিনীর সংগে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগসূত্র সৃষ্টি হয়। ঐ একই রাতে দুই বাহিনী সম্মিলিত শক্তির সমন্বয়ে প্রথম কপিলমুনি রাজাকার ঘাটি আক্রমন করা হয়। সেই যুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর একজন নিহত হয়। সারারাত যুদ্ধ চালিয়ে পুনরায় জালালপুর মোড়ল আব্দুল করিমের বাড়িতে ফিরে আসেন। দুপুরের দিকে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে খুলনা থেকে খাদ্য, অস্ত্র, গোলা বারুদ এবং বেশ কিছু রাজাকার নিয়ে জালালপুর মুক্তিযোদ্ধা ঘাটির পাশ দিয়ে কপিলমুনি যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চটিকে আক্রমন করে। ঐ সময় লঞ্চ থেকে রাজাকাররা নদীতে ঝাপ দিয়ে পাইকগাছা উপজেলার দেয়াড়া রহিমপুর এলাকার কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে উঠে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে একজন রাজাকার নদীতে নিহত হয়। ঐ লঞ্চে থাকা স্টাফসহ সারেং কাকুতি মিনতি ও কান্নাকাটির ফলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডা লেঃ শামসুল আরেফিন তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দেন। আবু বকর বলেন ধারণা করা হয় ঐ লঞ্চটি খুলনায় পৌছে জালালপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং লঞ্চ আক্রমনের প্রেক্ষাপট পাক বাহিনীকে অবহিত করে। এর পর দিনই পাক বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গান বোটযোগে জালালপুর গ্রামের পূর্বপাশদিয়ে প্রবহমান কপোতাক্ষ নদীতে চলে আসে তখন সময় অনুমান বিকাল ৩ টা। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর বলেন ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া দাওয়া প্রস্তুতি চলছিল। হঠাৎ গানবোটের শব্দ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সতর্কতার সাথে নদীর দিকে এগিয়ে যান এবং গানবোট দেখতে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর-এর নেতৃত্বে পাক বাহিনীর গানবোট লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি বর্ষন শুরু করে। এদিকে পাকবাহিনী গানবোট থেকে মেশিনগানের ব্রাশফায়ার ও দুর্বার গতিতে নদীর কূলের দিকে এগুতে থাকে। পাক বাহিনী অত্যাধুনিক ব্রাশ ফায়ারে ঐ অঞ্চলের আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং স্থান ত্যাগ করে। পুনরায় পাক বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পাক বাহিনীরা গানবোট হতে নেমে জালালপুর ও পাশ^বর্তী শ্রীমন্তকাটি গ্রামের লোকালয়ে প্রবেশ করে। নির্বিচারে নারী শিশু যুবক যুবতী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করে। পাকবাহিনী গুলিতে সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন আবু বকর সাহেবের ভাষ্যমতে তালা উপজেলার জালালপুর গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ অন্নদা চরণ সেন, মোবারেক মোড়ল, হরিপদ ঘোষ, অধীর কুমার ঘোষ, অনিমা দাশ ও তার শিশু পুত্র দীপঙ্কর দাশ, আছিরোন বিবি, পীর আলী কারিগর, সুনীল কুমার সেন, অশোক পরামানিক ও তার অজ্ঞাত নামের পুত্র, তেজেন্দ্র নাথ সেন-এর স্ত্রী, শ্রীমন্তকাটি গ্রামের সানু মোড়লসহ আরও নাম না জানা অসংখ্য মানুষ হত্যা করা হয়।
নরপিচাশীরা পরলোকগত প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বি,এ করিম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিমের বিশাল বাড়িসহ প্রায় চল্লিশ পরিবারের বসত বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং উক্ত বাড়ীগুলো থেকে ধন-সম্পদ স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। পরদিন তালা উপজেলার মুজিব বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা স.ম বাবর আলীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্ব স্ব কমান্ডের অধীনে ফেরত দিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের দক্ষিণ খুলনা তথা সাতক্ষীরা জেলার এই অজানা ইতিহাস পাকবাহিনী কর্তৃক তালা উপজেলার জালালপুর ও শ্রীমন্তকাটি গ্রামের গণহত্যা প্রেক্ষপট প্রজন্ম ৭১-এর স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রম করলেও এর নিকট আজও অজানা। জালালপুরের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য এ ধরনের কাহিনী ভয়াবহ বহু অজানা প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে যা কালের ¯্রােতে বিলীন হয়ে যাবে কী? মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত এ সকল ইতিহাস প্রজন্ম ’৭১ কে অবহিতকরণসহ সংরক্ষনের লক্ষ্যে বর্তমান মুক্তিদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ সরকার প্রধান তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তালা উপজেলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সংরক্ষণ পরিষদ-এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সাথে কমিটির পক্ষ থেকে আশংঙ্কা করছি যে, কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্র শহীদদের স্মৃতি পবিত্রতা রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তার চিন্তা চেতনা ছিল বাম, প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ধারা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আদর্শগত মতাদর্শের কারণে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে বাংলদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রীক দল জাসদ গঠিত হয়। সেই দলের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পতাকাতলে সংগঠিত করার কাজে (১৯৭২-১৯৮০ সাল পর্যন্ত) মোড়ল আবু বক্কারের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। গোটা সাতক্ষীরা জেলাসহ পাশর্^বর্তী খুলনা জেলার পাইকগাছা-কয়রা উপজেলা এ সকল অঞ্চলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পরিচয় ছিল অসাধারণ। এ সকল অঞ্চলে সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও ক্রীড়া অঙ্গনের বাঙালী জাতীকে মূল ¯্রােত ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৮৮ সালে তালা সরকারি কলেজে ভূগোল বিষয়ের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন এবং পরবর্তী যশোর এম এম কলেজে বদলী হয়ে অধ্যাপনা করে সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মোড়ল আবু বক্কারের ভাষায় বলা যায় যে, এ বিশে^ যত ভাষা এবং জাতী আছে। সেই সকল ভাষা এবং জাতীর তুলনায় বাংলা ভাষা ও বাঙালী জাতী কোন অংশে কম নয়। ভূমিহীন মানুষদের পূনর্বাসনের জন্যও তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম সে হিসাবে তিনি উত্তরণ কর্তৃক গঠিত তালা উপজেলা ভূমি কমিটিতে তিনি সহ-সভাপতির পদে, জেএসডি সাতক্ষীরা জেলার সহ-সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা লীগ-এর তালা উপজেলার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা। তাছাড়া কপিলমুনি মোড়ল আঃ সালাম ট্রাষ্ট-এর সদস্য ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে আমৃত্যুকাল পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। অবশেষে এই বরেণ্য ব্যক্তি অসুস্থ্য হয়ে খুলনা আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারী রোজ মঙ্গলবার সেখান থেকে না ফেরার দেশে চলে যান এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রথখোলা মাঠে জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক গোরস্থানে শায়িত করা হয়। আমরা এই গুণি ব্যক্তির ব্যক্তির আদর্শকে বুকে ধারণ করে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক :: মীর জিল্লুর রহমান
সাধারণ সম্পাদক
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)
সাতক্ষীরা জেলা শাখা।
মোবাঃ ০১৭২১-১৯৭৩২৯


Top